IPL 2025: প্রথমে ব্যাটিং করাই এখন বাড়তি সুবিধা, আর শেষ দুই সপ্তাহে স্পিনাররা ছাড়িয়ে গেছেন পেসারদের।

আইপিএল ২০২৫-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে দেখা দিয়েছে কিছু চমক। ব্যাটিং আগের মতো সহজ হয়নি এবং প্রথম ১০টি ম্যাচে রান তোলার যে গতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল, তা অনেকটাই কমে এসেছে। পাওয়ারপ্লেগুলো এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে, কারণ গত আসরের বিধ্বংসী ওপেনাররা এই আসরে নিজেদের পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারেননি। প্রথমে ব্যাটিং করাই এখন সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে এবং স্পিনাররা গত দুই সপ্তাহে পেসারদের ছাড়িয়ে গেছেন। এছাড়া আইপিএলের দুই শক্তিশালী দল — চেন্নাই সুপার কিংস ও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, যাদের মিলিয়ে রয়েছে ১০টি শিরোপা — এই আসরে এখন পর্যন্ত খুবই হতাশাজনক সময় কাটাচ্ছে।
রান তোলার হারে বিশাল পতন
এই মৌসুমের প্রথম ১০টি ম্যাচে গড় রান-রেট ছিল ৯.৯১ এবং এটি আরও বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। তবে এরপর পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং রান তোলার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ম্যাচ ১১ থেকে গড় রান-রেট নেমে আসে ৯.২৯-এ।
গত বছরের বিপ্লবী মৌসুমের একটি বড় দিক ছিল পাওয়ারপ্লেতে দুর্দান্ত ব্যাটিং। সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, কলকাতা নাইট রাইডার্স এবং দিল্লি ক্যাপিটালস প্রথম ৬ ওভারে প্রতিপক্ষ বোলারদের উপর ঝড় তুলে রেকর্ড ভেঙেছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই মৌসুমের প্রথম ১০ ম্যাচেও পাওয়ারপ্লেতে গড় রান-রেট ছিল ১০.২। তবে এরপর এই সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। পরবর্তী ১৫ ম্যাচে (ম্যাচ ১১ থেকে ২৫) পাওয়ারপ্লের গড় রান-রেট নেমে এসেছে ৯.০১-এ।
২০২৪ আইপিএলে এসআরএইচ-এর পাওয়ারপ্লে রান-রেট ছিল ১১.২ এবং কেকেআর ১১.১ রান-রেটে শিরোপা জিতেছিল। এবার দুই দলই নতুন বলে নিজেদের আগ্রাসন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। এই মৌসুমে তাদের পাওয়ারপ্লে রান-রেট যথাক্রমে ৯.৭ এবং ৯.৯। এমনকি এবারের টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত অপরাজিত দিল্লি ক্যাপিটালসও তাদের পাওয়ারপ্লে রান-রেট ২০২৪-এর ১০.৭ থেকে এবার ৮.৩-তে নামিয়ে এনেছে।
ছক্কা মারার হার এবং ২০০-এর বেশি রান করা ইনিংস
এই মৌসুমের প্রথম ১০ ম্যাচে মোট ২০৪টি ছক্কা পড়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ম্যাচে ২০টি করে ছক্কা। তবে পরবর্তী ১৫ ম্যাচে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪৮ (গড়ে ১৬.৫ ছক্কা প্রতি ম্যাচে)।
প্রথম ১০ ম্যাচে ২০০ বা তার বেশি রান হয়েছিল ৬ বার। তবে পরবর্তী ৯ ম্যাচে মাত্র ৩ বার। তবে হঠাৎ করেই শেষ ৬ ম্যাচে আবার ৭ বার ২০০-এর বেশি রান হয়েছে। যদিও এই ভারসাম্য রক্ষার জন্য সমানতালে নিম্নমানের ইনিংসও দেখা গেছে — শেষ ১৫ ম্যাচে ৯ বার কোনো দল ১৭০ রানের নিচে অলআউট বা ইনিংস শেষ করেছে।
রান তাড়া করা আর সুবিধাজনক নয়
প্রথম ১০ ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করা দল সামান্য সুবিধা পেয়েছিল — তারা ৬টি ম্যাচ জিতেছিল। তবে পরবর্তী ১৫ ম্যাচে চিত্র উল্টো। লক্ষ্য নির্ধারণ করা দল ৯টি ম্যাচ জিতেছে এবং ৬টি হেরেছে। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে প্রথম ব্যাটিং করা দল সব তিনটি ম্যাচ জিতেছে। মুল্লানপুরেও প্রথম ব্যাটিং করা দল দুটি ম্যাচেই জয়ী হয়েছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো — এবারের আসরে লক্ষ্য তাড়া করাকে সুবিধাজনক না মনে হলেও টস জেতা অধিনায়ক ২৫ ম্যাচের মধ্যে ২২ বারই ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! এটি আসলে আইপিএল এবং সামগ্রিকভাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ‘চেজিং-বায়াস’ বা লক্ষ্য তাড়া করার প্রতি পক্ষপাতিত্বেরই প্রমাণ।
হায়দরাবাদে রানবন্যা, চেপকের ধীর গতির উইকেট
হায়দরাবাদের উপ্পলের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম এবারের আসরে একেবারে ব্যাটিং স্বর্গে পরিণত হয়েছে। তিনটি ম্যাচে গড় রান রেট ১০.৮! সানরাইজার্স হায়দরাবাদ তাদের প্রথম ম্যাচেই এই ভেন্যুতে তুলেছে ২৮৬ রান — যা আইপিএল ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দলগত সংগ্রহ। এই মাঠে ডট বলের হার সবচেয়ে কম (১৮.২%) এবং প্রতি চার বা ছক্কা আসছে মাত্র ৩.৯ বলে।
অন্যদিকে চেন্নাইয়ের চেপক স্টেডিয়াম ছিল এবারের আসরের সবচেয়ে কঠিন স্কোরিংয়ের ভেন্যু। সেখানে গড় রান রেট মাত্র ৭.৬। প্রতি ৬.৫ বলে একটি করে বাউন্ডারি হচ্ছে। ডট বলের হারও অনেক বেশি — ২৯.২%।
স্পিনারদের দাপট
আইপিএল ২০২৫-এ এখন পর্যন্ত স্পিনাররাই পেসারদের চেয়ে বেশি সাফল্য পাচ্ছেন। স্পিনাররা মোট ১১৮টি উইকেট নিয়েছেন ২৯.১ গড়ে, ১৯.৮ স্ট্রাইক রেটে এবং ৮.৮ ইকোনমিতে। অন্যদিকে পেসাররা প্রতি ৩০ রানে একটি করে উইকেট পেয়েছেন, স্ট্রাইক রেট ১৮.৩ হলেও ইকোনমি ছিল ৯.৮৪ — যা অনেক বেশি।
নূর আহমেদ, সাই কিশোর, বরুণ চক্রবর্তী, কুলদীপ যাদব, দিগ্বেশ রাঠি ও বিগনেশ পুত্থুর ছিলেন সেরা স্পিনারদের মধ্যে। মজার ব্যাপার, এদের মধ্যে চারজনই বাঁ-হাতি।
পতনের মুখে মুম্বাই ও চেন্নাই
আইপিএলের দুই প্রথিতযশা দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স এবং চেন্নাই সুপার কিংস এবারের আসরে কার্যত ধুঁকছে। মুম্বাই পাঁচ ম্যাচের মধ্যে জিতেছে মাত্র একটি এবং আছে পয়েন্ট টেবিলের ৮ নম্বরে। ওপেনিংয়ে ভালো শুরু পাচ্ছে না দলটি। রোহিত শর্মা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দারুণ ফর্মে থাকলেও মুম্বাইয়ের হয়ে ব্যর্থ। চার ইনিংসে করেছেন মাত্র ৩৮ রান। উইল জ্যাকসও ছিলেন ব্যর্থ, চার ইনিংসে করেছেন মাত্র ৫৪ রান। মুম্বাইয়ের ওপেনিং জুটি গড়ে তুলেছে মাত্র ১৭.২ রান — যা এবারের আসরের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
বোলিংয়ে প্রথম চার ম্যাচে জসপ্রীত বুমরাহ না থাকায় নতুন বলে কোনো ধার ছিল না। পাওয়ারপ্লেতে মুম্বাইয়ের বোলিং গড় ৫১.৮ এবং ইকোনমি ছিল ১০.৪।
অন্যদিকে, চেন্নাই সুপার কিংসের অবস্থা আরও করুণ। ছয় ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতেই হেরেছে দলটি। ব্যাটিং লাইনআপ একেবারেই বিপর্যস্ত। দলগত ব্যাটিং গড় ২৪.১ — যা এবারের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কোনো উদ্যম বা আগ্রাসী মনোভাব নেই। স্ট্রাইক রেট মাত্র ১৩১.৮ — যা এবারের আসরের সবচেয়ে কম। তার ওপর, দলের অধিনায়ক এবং ব্যাটিং ভরসা ঋতুরাজ গায়কওয়াড়ের কনুই চোটে পড়ে পুরো টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাওয়া চেন্নাইয়ের জন্য বাড়তি ধাক্কা।
